অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম
জেনেভা কনভেনশান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি তার জাতি,ধর্ম, নাগরিকতা, বিশেষ সম্প্রদায়, অথবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে নিপীড়নের এমন আশঙ্কা করেন যা সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য –প্রমানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ; সেই নিপীড়নের আশংকার কারণে যদি সে যে দেশের নাগরিক তার বাইরে অবস্থান করে, এবং নিজ দেশে নিরপত্তা না পাওয়ায় আশংকা করে, অথবা উক্ত নিপীড়নের আশঙ্কার দরুন নিজ দেশের নিরপত্তা ব্যবস্থার উপর আস্থাহীন হয় এবং পূর্বে যে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল সেই দেশে ফিরতে পারছে না, অথবা উক্ত নিপীড়নের আশংকার দরুন সেই দেশে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক হয় তবে উক্ত ব্যক্তিকে শরনার্থীর মর্যাদা প্রদান করা হয়|
এখন প্রশ্ন হল লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীরা কি জেনেভা কনভেনশান অনুযায়ী শরণার্থী মর্যাদা পেতে পারে?
গত ১৬ জানুয়ারী ২০২৪ (মঙ্গলবার) ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে) এ বিষয়ে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। লুক্সেমবার্গে অবস্থিত ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস রায়ে বলেছে যে, যদি কোন নারী তাদের জন্মগ্রহণকারী দেশে তাদের লিঙ্গের কারণে যৌন সহিংসতা এবং পারিবারিক সহিংসতা সহ শারীরিক বা মানসিক সহিংসতার শিকার হোন বা শিকারের ঝুঁকিতে থাকেন তবে তারা সুরক্ষার জন্য আবেদন করতে পারে এবং তাদের শরণার্থী মর্যাদা দেওয়া হবে।
কোন নারী তার জন্ম গ্রহনকারী দেশে পারিবারিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হলে জেনেভা কনভেনশনের অধীনে নারীরা সামগ্রিকভাবে একটি সামাজিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত মর্মে বিবেচিত হতে পারে এবং একইভাবে শরনার্থী মার্যাদা লাভের অধিকারী বলে ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিশ উক্ত রায়ে উল্লেখ করেছে।
একজন কুর্দি বংশোদ্ভূত তুর্কি মুসলিম নাগরিক ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে) এ মূল মামলাটি দায়ের করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, তার পরিবার তাকে বিয়েতে বাধ্য করেছিল। পরবর্তীতে তার স্বামী তাকে হত্যার হুমকি ও মারধর করেছে এবং এখন তিনি তালাকপ্রাপ্ত নারী।
তার স্বামীকে ছেড়ে তিনি বুলগেরিয়ায় পালিয়ে যান এবং তিনি তুরস্কে ফিরে গেলে তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে মর্মে উল্লেখ করে তিনি বুলগেরিয়াতে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন।
গত ১৬ জানুয়ারী ২০২৪ (মঙ্গলবার) এ প্রদত্ত রায়ে ইসিজে উল্লেখ করেছে যে, শরণার্থী মর্যাদা "এমন ক্ষেত্রে দেওয়া হবে যেখানে তৃতীয় দেশের নাগরিক জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতামত বা নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যতার কারণে নির্যাতিত হয়।"
ইসিজে রায়ে আরো উল্লেখ করে যে "সামগ্রিকভাবে নারীকে একটি সামাজিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষ্যে শরণার্থী মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। এটি সেই ক্ষেত্রে হবে যদি তারা জন্ম গ্রহণকারী দেশে তাদের লিঙ্গের কারণে যৌন সহিংসতা এবং পারিবারিক সহিংসতা সহ শারীরিক বা মানসিক সহিংসতার শিকার হোন।"
ইসিজে রায়ে আরো যোগ করে বলেছে যে, যদি কোন নারী সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত নিয়মের কথিত লঙ্ঘনের কারণে তার পরিবার বা সম্প্রদায়ের কোন সদস্য দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃর্ত্যুবরণের বা সহিংসতার শিকার হওয়ার সত্যিকারের ঝুঁকি নিয়ে থাকে, তবে তিনি শরণার্থী মর্যাদা দেওয়ার শর্তগুলি সম্পূরূপে পুরন না হওয়া স্বত্বেও সাবসিডিয়ারি সুরক্ষা মর্যাদার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
পারিবারিক ও যৌন সহিংসতা থেকে নারীদের সুরক্ষার জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই রায় আশ্রয় নীতিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সমগ্র ইউরোপের আদালত সমুহ অনেক মামলায় ইসিজে রায় দ্বারা নির্ধারিত মান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। তবে, এই রায়টি ইইউ সদস্য রাষ্ট্রে কীভাবে কার্যকর করা হয় তা এখন দেখার বিষয়। আশা করা যায় এই রায়ের প্রভাব ইতিবাচক হবে।
ইসিজি প্রদত্ত রায়টি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশীসহ অন্যান্য দেশের নারী আশ্রয় প্রার্থীরা আরও বেশি সুরক্ষা পাবেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও সহিংসতার শিকার নারীকে সুরক্ষা প্রদানের উদ্দশ্যে ২০২৩ সালের জুন মাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইউ) ইস্তানবুল চুক্তি অনুমোদন করেছে।
***লেখক প্যারিস, ফ্রান্স এ বসবাসরত একজন বাংলাদেশী আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হিউম্যানিটারিয়ান ল, ইতালি কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক শরনার্থী বিষয়ক আইনে উচ্চতর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স(জে এমবিএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মানবাধিকারকার্মীদের জন্য প্রবর্তিত ম্যারিয়েন ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স প্রোগ্রামের ২০২৩ সালের লরিয়েট।
No comments:
Post a Comment